হুসাইন বিন আফতাব, নিজস্ব প্রতিবেদক :
সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং গ্রামীণ অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) পরিচালিত এক অনুসন্ধানভিত্তিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই চিত্র। শ্যামনগরের ১৪টি গ্রামের ৩১ জন কৃষকের অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
বুধবার (৬ আগস্ট) বেলা ১১টায় শ্যামনগর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন বারসিকের কর্মসূচি কর্মকর্তা মোঃ মফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বারসিকের উপকূলীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার।
গবেষণায় দেখা যায়, ধান ও সবজি চাষে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করতে কৃষকরা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করছেন। ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ বহু পণ্যও রয়েছে। এসাটপ, ডেল এক্সপার্ট, ক্যারাটে, ফোলিকুর, জোয়াস, ফার্মকট, মিমটক্স, কনজাপ্লাস, মর্টারসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক নামের বিষাক্ত রাসায়নিক পণ্য নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা হচ্ছে। কৃষকরাই নিজেরাই এসব স্প্রে প্রয়োগ করছেন, যা তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।
অনেক কৃষক দীর্ঘদিন ধরে চুলকানি, চোখে ছানি পড়া, ঝাপসা দেখা, শ্বাসকষ্ট, বমিভাব, হাত-পা ঝিনঝিন করা, চর্মরোগ ও লিভারের জটিলতায় ভুগছেন। এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয়ে অনেক পরিবারই আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা ব্যয় চালাতে হয়েছে সঞ্চয় ভেঙে বা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বা বিভিন্ন ঋণ সহায়তায়।
কেবল স্বাস্থ্যগত ক্ষতিই নয়, কীটনাশকের প্রভাবে প্রাণিজগতেও ব্যাপক বিপর্যয় নেমে এসেছে। গবাদি পশু, হাঁস-মুরগির মৃত্যু, পুকুরের মাছ মরে যাওয়া, বাসাবাড়ির শিশু ও বৃদ্ধদের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, এমনকি ক্ষেতের লাউ, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজির ক্ষতিসাধন ঘটেছে।
সংবাদ সম্মেলনে কৃষক নজরুল ইসলাম, গহর কয়াল, গোপাল মন্ডল, কেনা মন্ডল, কওছারসহ একাধিক ভুক্তভোগী কৃষকের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়। বিষ প্রয়োগের নিয়ম-কানুন বা স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে তারা অবগত নন। অধিক ফলনের আশায় বিক্রেতাদের পরামর্শে এসব বিষ ব্যবহার করেন। কিন্তু ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বারসিক কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিলন, প্রতিমা রাণী চক্রবর্তী, সবুজ সংহতির প্রতিনিধি, স্থানীয় কৃষক ও কৃষাণী, শ্যামনগর উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রভাষক সামিউল মনির, সাধারণ সম্পাদক এস.এম মোস্তফা কামাল, সাংবাদিক রণজিৎ বর্মন ও যুব সংগঠক স.ম ওসমান গনী সোহাগ সহ প্রেসক্লাবে কর্মরত সাংবাদিকবৃন্দ।
বারসিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কীটনাশকের এ বিপজ্জনক ব্যবহার রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে উপকূলীয় জনপদ আরও বড় সংকটের মুখে পড়বে। তারা কীটনাশক ব্যবহারের আগে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, সহজ ভাষায় নির্দেশনা, গণমাধ্যমে সচেতনতা প্রচার, স্প্রে কাজে নিয়োজিতদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসন এবং জৈব ও বিকল্প কৃষি পদ্ধতির প্রসারে প্রয়োজনীয় সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা দাবি করেন।
গবেষণার আলোকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজ ও পরিবেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যকেই মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তুলছে। এখনই দায়িত্বশীল উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :